১৫ আগস্ট, ২০১৮

Someone excluded: Identity Inclusion

তারিখটা ঠিক খেয়াল নেই, তবে ঐদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ঠিক বিকেলের দিকে আমি টেকনিক্যাল মোড়ে আমার সহকর্মী রাফিউর রহমানের সাথে দেখা করতে যাই। উনি আজকে আমাকে টিপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন। টিপুর সমন্ধে আমি আইডেন্টিটি ইনক্লুশনের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামেই জানতে পেরেছিলাম, আর আজকে টিপুর সাথে সাক্ষাৎ করার পালা। বাংলা কলেজের গেইটের দিকেই একটি কনফেকশনারি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের ক্লায়েন্ট টিপুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

অপেক্ষা করতে করতে আমি আমার সহকর্মী রাফিউর রহমানের কাছে টিপুর সমন্ধে আরোও জানতে চেয়েছিলাম কারন উনি
ইতিমধ্যেই টিপুর সাথে সাক্ষাৎ করে গেছেন, উনি বললো চিন্তার কিছু নেই টিপু নরমাল আছেন এবং শান্ত প্রকৃতির।


টিপুর সমন্ধে কথা বলতে বলতে এমন সময় টিপুর বাস চলে আসলো
, রাফিউর ভাই দ্রুত গেলো টিপুকে বাস থেকে নামিয়ে আনার জন্য, আমি একটু চিন্তিত ছিলাম পরে দেখলাম বেশ হাসি খুশি একটা ছেলে বাস থেকে নামলো, টিপুকে দেখে কেউ চিন্তাও করবে না, যে ওর কোনো মানসিক রোগ আছে। রাফিউর ভাই টিপুকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে আসলো আর এইটাই ছিলো টিপুর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

টিপু একজন
তরুণ বয়স্ক ছেলে যে মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা আক্রান্ত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমরা যখন একই সময়ে একটি বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করি তখন টিপু একই সময়ে একাধিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করে এই কারনে টিপুর কথা বলার শুরু ও শেষের দিকের সঙ্গতি ঠিক থাকে না আর ওর চিন্তা ভাবনার দুনিয়াতে নেতিবাচক চিন্তা ভাবনার সংখ্যাই বেশি।

এরপর থেকেই সপ্তাহে
  দুই থেকে তিন বার টিপুকে  রিসিভ করার জন্য যাওয়া শুরু হয়ে গেলো। প্রথম দিকে টিপুর সাথে একই বিষয় নিয়ে কথা বলতে ঝামেলা হতো কারণ টিপু একটা বিষয় নিয়ে কখনোই কথা বলে না, সে বার বার কথার বিষয় পাল্টাতে থাকে। আ্মি যদি ফুটবল নিয়ে কথা বলি টিপুও কয়েক সেকেন্ড এটা নিয়ে কথা বলবে এরপর হঠাৎ করে বলে উঠবে আকরাম স্যার নাকি ওকে শুধু মারে। আর আমি যদি জিজ্ঞেস করি আকরাম স্যার কে? তখন টিপু যৌক্তিক কোনো উওর দিতে পারে না। এই কারণে প্রথম দিকে টিপুর কথার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা কিছুটা কষ্টসাধ্য ছিলো, এখনো আছে কিন্তু এখন আর আগের মতো অতোটা সমস্যা হয় না।

টিপু সবার মতো সমাজে চলাফেরা করলেও সে সবার থেকে আলাদাই রয়ে যায়
, সব সময় মাথা নুয়ে চলাফেরা করে, সে প্রকাশ্যে হাসতে জানে না, কারো সাথে নিজ থেকে কথা বলে না, সে শার্টের সব গুলো বোতামও লাগায় না, টিপু অনেক হাটতে পারে কিন্তু তার হাটার ভজ্ঞিমাতেও যেনো একটা ভাগ্যবিপর্যয়ভাব চলে আসে। এই কারণে ভিড়ের মধ্যে অনেকের নজরই টিপুর দিকে থাকে। টিপুর সামাজিক মর্যাদা অনেকটাই অবহেলিত, বাসে টিপুর মতো মানুষদের জন্য আলাদা সিট থাকা শর্তেও তাকে বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে আসতে হয়, সিটে বসে থাকা কিছু মানুষের সাহায্য চাইলেও সাহায্য পাওয়া যায় না, বাসের হেল্পারও টিপুকে সাহায্য করতে চায় না কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমাদের সমাজে কিছু ভালো মানুষ আছে যাকে একটূ অনুরোধ করলেই টিপুর মতো মানুষদের জন্য সিট ছেড়ে দেয়, কিছু মানুষ বাস থামিয়ে টিপুকে নামিয়েও দেয়। রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় টেকনিক্যাল মোড়ের সার্জেন্টরাও অনেক সহায়তা করেন। এই গুটিকয়েক মানুষগুলোর মাধ্যমেই টিপুকে কার্যক্ষম কিছু করার জন্য উত্সাহ দেয়া সম্ভব।

টিপু নবম শ্রেণীর পর থেকেই এই
মানসিক রোগ দ্বারা ভুগছে। এর কারণে টিপুর আচার আচরণেও বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষনীয়, মাঝে মধ্যেই নাকি টিপু বাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো, কয়েকবার চলেও গিয়েছিলো পরে অনেক খুজাখুজির পর তার পরিবার তাকে পেয়েছে, সেই সাথে অপ্রাসঙ্গিক কথা বার্তা তো আছেই। টিপুকে সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরই টিপুর পরিবার জানতে পেরেছে টিপু মানসিক রোগ  সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা আক্রান্ত। এমন অবস্থাতেই টিপু এস.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করে, এরপর কলেজে প্রথম বর্ষে পাশ করে দ্বিতীয় বর্ষতে যেয়ে সে সমাজের প্রতিবন্ধকতা গুলোর সামনে টিকতে পারেনি ফলস্বরূপ তাকে পড়াশোনা ছেরে দিতে হয়েছে।

টিপু অনেক মেধাবী, ইতিহাসে ওর ভালো জ্ঞান আছে। ম্যাথে তো আমার থেকেও ভালো। রসায়ন পড়তে নাকি টিপুর অনেক ভালো লাগে। টিপুর বেড়াতে যেতে ভালো লাগে, চকোলেট আর আইসক্রিম টিপুর অনেক প্রিয়। এক কথায় বাচ্চাদের যতো কাজ আছে সবই ওর ভালো লাগে। আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি টিপু অনেক ভালো
শ্রোতা, ওর সাথে ইংরেজী ভাষায় কথা বললেও টিপু খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে আর এইটা হচ্ছে চমৎকার একটা গুণ পাশাপাশি টিপুর বিনীতভাবে উত্তর দেয়ার ভজ্ঞি প্রশংসা করার মতো।

আইডেন্টিটি ইনক্লুশনের একজন সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্টার হিসেবে আমি এবং আমার টীম সর্বদা চেষ্টা করে যাচ্ছি টিপুকে যথোপযুক্ত সহায়তার মাধ্যমে একজন স্বাধীন
ব্যক্তিগত পরিচয় সম্পুর্ণ মানুষ হিসেবে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে আর এর জন্য আমাদের সবাইকে টিপুর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। টিপু যে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে সেইটাও নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না হয়তো টিপুর বর্তমান অবস্থাই তার জন্য স্বাভাবিক যেটা হয়তো আমাদের চোখে স্বাভাবিক নাডেনিয়েল ফিসার নামের একজন ব্যাক্তিও অনেক বছর সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা আক্রান্ত ছিলো তারপর তিনি যখন আরোগ্য লাভের জন্য মন স্থির করলেন তখন সিজোফ্রেনিয়া থাকাকালীন অবস্থায়ই একজন ন্যাশনাল লিডার হয়েছিলেন। ডেনিয়েল ফিসার সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে একটি বইও লিখেছেন আর বইটি হচ্ছে-"Heartbeats of Hope: The Empowerment Way to Recover" ডেনিয়েল ফিসার সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা তার এই বইতে উল্লেখ করেছেন।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের একটা সাপোর্ট সিস্টেমের অনেক বেশি প্রয়োজন, এক মাত্র এর মাধ্যমেই তাদেরকে সমাজে কার্যকরীভাবে সক্রিয় রাখা সম্ভব।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
;